সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্ববর্তী ব্লগটিতে (ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ) আমি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় খাদ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ করেছি । অবশ্যই তা একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বলাই বাহুল্য যে তার বাইরে অনেক উপাদেয় পদ রয়েছে, কয়েকটি আইকনিক পদ ও প্রণালীকে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি কর্মসূত্রে বা বেড়াতে গেলে পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ওই সকল স্থানীয় খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। আজকের এই ব্লগটিতে আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন খাদ্য পদ নিয়ে আলোচনা করব, অন্যথা আমাদের দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যে আলোচনা আমি শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ভারতবর্ষ অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতির আবাসস্থল। দেশের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপজাতিরা তাদের অনন্য রীতিনীতি, ভাষা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন বা করে চলেছেন। এই ব্লগে, আমরা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডারের অন্বেষণ করব যা এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময়কাল ভারতেবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কাজেই কিছু ক্ষেত্রে এই লেখা আমার কাছে অনেকটা নস্টালজিয়ার মতন। বাংলা সাহিত্যেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের খাদ্যের বা খাদ্যরীতির কথা উঠে এসেছে। এই মুহুর্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের 'আরণ্যক' উপন্যাসটির কথা মনে আসছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে লিখেছেন- 'আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্বে-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে এক প্রসিদ্ধ মেলা বসে। ....... মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটি সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।'
সত্যজিত রায় মহাশয়ের পরিচালিত 'আগুন্তুক' ছায়াছবিটি আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন মিত্র আদিবাসীদের কৃষি, বুনন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ঔষধি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির কথা সাধারণ শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি অনিলা দেবীর পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধুর সামনে তুলে ধরেন, যদিও তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কাটে, মনমোহন বলেন তিনি আদিবাসী নন বলেই তাঁর ফিল্ড নোট (Field notes) নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্যি, আজ পৃথিবী যখন স্থায়িত্বের (Sustainability) জন্যে লড়ে যাচ্ছে, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ থেকেই নেওয়া ফিল্ড নোটগুলি উল্টাতে হয় বইকি, তাতেই যে রয়েছে স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।
ভারতে উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালী ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, জমি, ঋতু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি ব্যবহার করেন। উত্তর-পূর্বের জঙ্গল থেকে শুরু করে রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভূগোল, জলবায়ু এবং সাংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত স্বতন্ত্র রন্ধনসম্পর্কীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব করে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, আদিবাসী উপজাতিদের আবাসস্থল, খাদ্য শুধুমাত্র ভরণ-পোষণ নয় বরং জীবনের একটি উদযাপন। ভাত, মাছ, শুঁটকি মাছ এবং বাঁশের আগা (Bamboo shoot) এই অঞ্চলের অনেক উপজাতীয় খাদ্যের ভিত্তি। নাগাল্যান্ডের নাগা উপজাতিরা তাদের ঝাল ঝাল সুস্বাদু মাংসের খাবারের জন্য বিখ্যাত, প্রায়শই শক্তিশালী 'ভুত ঝোলোকিয়া' মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতিরা সুস্বাদু আচার এবং চাটনি তৈরি করতে বাঁশের আগা ফার্মেন্ট করেন, যা খুবই উপাদেয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন কীট-পতঙ্গকে খাদ্য (Edible insects) হিসেবে ব্যবহার করেন। অরুণাচল প্রদেশে বিভিন্ন উৎসবে মিথুনের মাংস (Bos frontalis) মানুষের রসনা তৃপ্ত করে। এখানে মুরগি বা মাটনের থেকে শুয়োরের মাংসের আধিক্য দেখা যায়। পানীয়ের মধ্যে অরুণাচলের আপং (Apong-rice beer), নাগাল্যান্ডের জুথো (Zutho), সিকিমের ছাঙ (Chang) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার মিজোদের স্থানীয় ডেলিকেসি জাওলাইদি- আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন (Zawlaidi- Grape wine) এক প্রেমের গল্প বলে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পানীয় গ্রহণে কোনো বৈষম্য আমি দেখিনি, স্থানীয় মানুষকে মাতলামি করতেও আমার বিশেষ চোখে পড়েনি।
মধ্য ভারত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, প্রত্যেকের নিজস্ব রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের গোন্ড এবং বাইগা উপজাতিরা মহুয়া ফুল, তেন্দু পাতা ইত্যাদি বনজ পণ্যের দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মহুয়া, বিশেষ করে, উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালীতে একটি বিশেষ স্থান রাখে, যা আলকোহলিক পানীয় (Alcoholic beverages) এবং মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন মিলেটের, যেমন কোদো, কুটকি ইত্যাদির ব্যবহার (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট), বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়িত্ব এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণ খুবই প্রাসঙ্গিক। ছত্তিশগড়ের লাল পিঁপড়ের চাটনী, ঊড়িষ্যার G.I. ট্যাগ প্রাপ্ত 'কাই-চাটনী' (লাল পিঁপড়ের চাটনী- watery semi-solid paste of red weaver ant), মধ্য ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য হিসেবে শামুকের (Edible snails) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
সবুজ পশ্চিম ঘাটের মাঝখানে অবস্থিত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরালার উপজাতি সম্প্রদায়গুলি রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দের একটি আকর্ষণীয় সম্ভার অফার করে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি উপজাতি, তাদের শিল্পের জন্য পরিচিত, এছাড়াও রন্ধনশিল্পে পারদর্শী, পিঠলা-ভাকড়ি (Pithla-Bhakri- খামিরবিহীন রুটির সাথে বেসনের তরকারি) এর মতো হৃদয়গ্রাহী খাবার তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে কুরিচিয়া এবং কুরুম্বা মতো আদিবাসী উপজাতিরা বনের সবুজ শাক (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক), মিঠা পানির মাছ এবং বন্য মাংস দিয়ে রান্নার শিল্প আয়ত্ত করেছে, এমন খাবার তৈরি করেন যা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।
পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের কেন্দ্রস্থলে, রন্ধন প্রথাগুলি প্রকৃতি উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের আচারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি ফসল কাটার মরসুম উদযাপন করে সোহরাই নামে পরিচিত একটি জমকালো ভোজের সাথে, যেখানে 'ধুসকা' (Dhuska- ডিপ-ফ্রাইড রাইস প্যানকেক) এবং পিঠা-র মতো খাবার রয়েছে। এদিকে, ওডিশার বোন্ডা উপজাতি বন্য মাশরুম, কন্দ এবং সবুজ শাক তাদের প্রতিদিনের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করে।
আধুনিকীকরণ (?) এবং পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের সমৃদ্ধ উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রজম্নের পর প্রজন্ম মুখে মুখেই প্রচলিত, লিখিত ভাবে না থাকার জন্যে তা অবক্ষয়িত, এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই আমাদের সেই ফিল্ড নোটগুলিকেই ভরসা করতে হয়। 'আগুন্তুক' ছবিতে নিজের চিকিৎসার জন্যে মনমোহন মিত্র এমন এক ওঝাকে ডেকেছিলেন যাঁর নখদর্পনে ছিল ৫০০ ঔষধি গাছ-গাছড়ার গুণাবলীর তথ্য, এ কিন্তু নেহাত কল্পনা নয়, এরূপ উদাহরণ আমি দেখেছি। তবে স্থানান্তর (Migration), স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় (Ecosystem degradation), জীব বৈচিত্রের হ্রাস (Biodiversity loss) পাওয়া ইত্যাদির ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার আজ ক্ষয়িষ্ণু। এই মূল্যবান জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। আদিবাসী সমাজের এই কম কার্বণ ফুটপ্রিন্ট (Low carbon footprint) বৈশিষ্টযুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা পরিবেশের স্থায়িত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে খাদ্য উৎসব, রন্ধনসম্পর্কীয় কর্মশালা এবং ডকুমেন্টেশন প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি দেশীয় খাবার এবং ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য উৎযাপন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, আমরা শুধুমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করি না বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকে লালন করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করি।
উপসংহারে, ভারতের উপজাতীয় খাবারগুলি প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের প্রমাণ যা সারা দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় থেকে মধ্য ভারতের রৌদ্রে ভেজা সমভূমি পর্যন্ত, এই সকল খাদ্যের প্রতিটি কামড় স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), ঐতিহ্য (Tradition) এবং খাদ্য ও সংস্কৃতির (Food culture) মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের গল্প বলে। পরিশেষে উল্লেখ করি, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।





























